
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৬৮ বছর কেটে গেছে। এই দীর্ঘ সময়ে ২২ জন উপাচার্য দায়িত্ব পালন করেছেন। এর বাইরে বিশেষ পরিস্থিতিতে উপাচার্যের রুটিন দায়িত্বে ছিলেন কয়েকজন। এখন ২৩তম উপাচার্যের অপেক্ষা। কিন্তু এই অপেক্ষার যেন শেষ নেই। প্রতিষ্ঠার পর নতুন উপাচার্যের জন্য এর আগে এতদিন অপেক্ষায় থাকেনি বিশ্ববিদ্যালয়টি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সবশেষ উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান। বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্যের দায়িত্ব পেয়ে তিনি একের পর এক ‘অনৈতিক ও নীতিবহির্ভূত’ কাজে জড়িয়ে পড়েন। শেষ কর্মদিবসে ‘অবৈধভাবে’ ১৩৮ জনকে নিয়োগ দিয়েছে দেশজুড়ে আলোচনায় আসেন। যদিও সেই নিয়োগপ্রাপ্তরা এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করতে পারেনি। এ ঘটনায় দফায় দফায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু এখনো ‘অবৈধভাবে’ নিয়োগ পাওয়াদের ‘ভাগ্য নির্ধারণ’ হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ধরনের ‘বিচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি’ সৃষ্টি করে তারা যোগদানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এম আবদুস সোবহানের উপাচার্য পদের মেয়াদ শেষ হয় গত ৬ মে। ওই দিন তিনি পুলিশি পাহারায় ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। তখন থেকে উপাচার্য পদটি ফাঁকা রয়েছে। এরপর কেটে গেছে ১০১ দিন। তবুও নতুন উপাচার্য পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়টি। যদিও রুটিন দায়িত্ব পালনের জন্য এরই মধ্যে দুজনকে উপ-উপাচার্যকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তথ্য বলছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক ইৎরাত হোসেন জুবেরী। তিনি দায়িত্ব নেন বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার দিন ৬ জুলাই ১৯৫৩ সালে। দায়িত্ব শেষ করেন ১৯৫৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় উপাচার্যের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে মাত্র একদিন। অর্থাৎ ১৯৫৭ সালের ১ অক্টোবর নতুন উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেন অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ। তিনি দায়িত্ব শেষ করার পরের দিনই তৃতীয় উপাচার্য নিয়োগ পান। তৃতীয় উপাচার্য মেয়াদ শেষ করার পরের দিন চতুর্থ উপাচার্য দায়িত্ব নেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে যাওয়ার একদিন পরেই পঞ্চম উপাচার্য দায়িত্ব নেন। দেশ স্বাধীনের আগে এটাই ছিল উপাচার্য পরিবর্তন পরিক্রমা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ষষ্ঠতম উপাচার্য নিয়োগ পান স্বাধীন দেশে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে নতুন উপাচার্যের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ২৩ দিন। ১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠতম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেন অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ। তার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরের দিনই সপ্তম উপাচার্য নিয়োগ পান। এভাবেই চলতে থাকে উপাচার্যের পালাবদল। এক উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আরেক উপাচার্য নিয়োগ পেতে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি।
এবার ২৩তম উপাচার্যের জন্য দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এই অপেক্ষা কবে শেষ হবে, তা কেউ বলতে পারছেন না। এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের ইচ্ছার উপরই নির্ভর করছে নতুন উপাচার্য কবে হবে।
উপাচার্য না থাকায় যেসব জটিলতা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ বডি হলো সিন্ডিকেট। সিন্ডেকেটের সভাপতি থাকেন উপাচার্য। কিন্তু গত মার্চের পর থেকে আর কোনো সিন্ডিকেট সভা অনুষ্ঠিত হয়নি ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। যদিও তিনটি সভা আহ্বান করা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত সেগুলো অনুষ্ঠিত হয়নি।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য সংখ্যা ১৮ জন। এর মধ্যে এখন রয়েছেন মাত্র ৮ জন। বাকি ১০টি পদ ফাঁকা রয়েছে। উপাচার্যের শূন্যতার কারণে সেই পদগুলো পূরণ করা যাচ্ছে না। যদিও আইনে বলা আছে, তিন শতাংশ সদস্য অর্থাৎ ছয়জন উপস্থিত থাকলে সিন্ডিকেট সভা আহ্বান করা যাবে।
সিন্ডিকেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্যাটাগরি থেকে সদস্য থাকেন ছয়জন। কিন্তু এখন সিন্ডিকেটে শিক্ষকদের মধ্যে থেকে অধ্যাপক ক্যাটাগরিতে আছেন একজন। ডিন, কোষাধ্যক্ষ, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক ক্যাটাগরিতে কোনো সদস্য এখন সিন্ডিকেটে নেই।
সিন্ডিকেটে থাকা অধ্যাপক ক্যাটাগরির সদস্য অধ্যাপক মো. হাবিবুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেট চালু না থাকলে অনেক কাজের সমস্যা হয়। যেমন আমাদের যে বাজেট করে সেটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দিতে হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এবারের বাজেটটা সিন্ডিকেট করতে পারেনি। অর্থনৈতিক যত কাজ, সব কাজে সিন্ডিকেটের অনুমোদন লাগে।
সিন্ডিকেটের এই সদস্য বলেন, অনেকে অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে সমস্যায় আছে, টাকাগুলো পাচ্ছে না। উপাচার্য নিয়োগ না হওয়ার কারণেই মূলত এই জটিলতাগুলো সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে সিন্ডিকেট বৈঠক ডাকা হচ্ছে না। এ ছাড়া শিক্ষকদের বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজন আটকে আছে। একাডেমিক ও প্রশাসনিক অনেক কাজই করা যাচ্ছে না উপাচার্য না থাকায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন অধ্যাপক বলেন, দেশে ’৭৩-এর অধ্যাদেশে স্বায়ত্তশাসিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তার মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। এখানে অন্তত ৩০ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এতদিন ধরে উপাচার্য নেই, এটা খুবই হতাশাজনক। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের দ্রুত উদ্যোগী হওয়ার কথা জানান তারা।