
বাজেটে বেসরকারি শিক্ষকদের নেই কোন সুখবর।
ম. শাহানূর আলম খাঁন , শিক্ষক ও নির্বাহী সম্পাদক
বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের প্রবল আঘাতে প্রায় ক্ষেত্রে স্থবির হয়ে পড়ার সমূহসম্ভাবনাময় অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার চ্যালেঞ্জ নিয়ে ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথ পরিক্রমা’ শিরোনামে সংসদে ২০২০-২১ অর্থ বছরের বাজেট পেশ করা হয়। ১১ জুন বিকাল সাড়ে তিনটায় অত্যন্ত কঠোরভাবে সামাজিক দূরত্ব মেনে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল এ বাজেট পেশ করেন। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। সংসদে আলোচনার পর, আগামী ২৯ জুন ২০২০ তা পরবর্তী অর্থবছরে বাস্তবায়নের জন্য পাশ হবে।
এ বাজেট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৮-তম, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালের ২য়, আওয়ামীলীগের ২১ -তম ও বাংলাদেশের ৪৯-তম বাজেট। বিভিন্ন কারণে এবারের বাজেট অন্যান্য বছর থেকে একটু ব্যতিক্রম।
আরো পড়ুন- জিডিপির অনুপাতে শিক্ষায় বরাদ্দ কমছে
অন্যান্য বছর বাজেটের ব্যাপারে জনসাধারণের মধ্যে যে উচ্ছলতা দেখা যেত এবার করোনার প্রভাবে অনেকটাই ম্লান মনে হয়েছে। চাপা উদ্বিগ্নতা কাজ করেছে অনেকের মনেই। অন্যান্য বছর যেসব স্বাভাবিক রীতিনীতি অনুসরণ করা হতো এবছর এগুলো অনেকাংশেই সীমিত করা হয়েছে। সীমিত সংখ্যক সাংসদের অংশগ্রহণে বাজেট অধিবেশন পরিচালিত হয়েছে।বিধিনিষেধ ছিল সাংবাদিকদের প্রবেশেও। বাংলাদেশ সংসদ টেলিভিশন থেকে সংবাদ কাভারেজ করার জন্য আগেই অনুরোধ করা হয়েছিল। ঢাকাস্থ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত,কূটনীতিক, তিনবাহিনী প্রধান, সিনিয়র সাংবাদিক, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বাজেট অধিবেশন উপভোগ করার যে রেওয়াজ প্রচলিত আছে এবছর তা করা যায়নি।
কোভিড-১৯ এর অভিঘাত মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ, ঋণনির্ভরতা প্রভৃতি মিলিয়ে এবারের বাজেট একটু ব্যতিক্রম-ই।
এবারের বাজেটে স্বাস্থ্যখাত, শিক্ষাখাত,কর্মসংস্থান, সামাজিক নিরাপত্তাবলয় সুৃদৃঢ়করণ প্রভৃতি বিষয়ে গৃহীত চ্যালেঞ্জিং পদক্ষেপসমূহ বাস্তবায়ন সময়ের একান্ত দাবি। স্বাস্থ্যখাতে আগের বাজেটের তুলনায় ৩ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। করোনাভাইরাস-১৯ এর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারও খুব তৎপর। তবে, যে হারে করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে তা দেখে মনে হয় – সারাদেশের আনাচে-কানাচে প্রচুর রোগী ছড়িয়ে আছে। তাদের শনাক্ত করে যত তাড়াতাড়ি পরিবার থেকে আলাদা রাখা যাবে ততই পরিবার ও সমাজের জন্য মঙ্গলজনক হবে। পরীক্ষা বিড়ম্বনা যথা- দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো, কয়েকদিন পর রিপোর্ট পাওয়া ইত্যাদি কারণে পরীক্ষা করাতেও অনেকে নিরোৎসাহ বোধ করে।
আরো পড়ুন- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি ৬ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ল
তাই দ্রুত ফলাফল পাওয়ার জন্য আরো অনেক এমনকি উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত করোনা পরীক্ষাগার, পরিচর্যা কেন্দ্র স্থাপন এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এ বাজেটে এরকম কোনো নির্দেশনা লক্ষ করা যায়নি। সর্বোপরি, করোনা পরিস্থিতি সামাল দিয়ে স্বাভাবিক গতিতে ফিরতে বেশ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে স্বাস্থ্য খাতকে।
এবারের বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট ৮৫ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে । শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৩ হাজার ১১৭ কোটি, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৮ হাজার ৩৪৪ কোটি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ২৪ হাজার ৯৪০ কোটি এবং বাকি ১৯ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তাহলে, একক শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দাঁড়ায় ৬৬ হাজার ৪০১ কোটি টাকা। ইহা মোট বাজেটের ১১.৬৯% যা গতবছর থেকে ০.০১% বেশি।
আবার, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে চলতি বাজেটে বরাদ্দ ছিল ১৫.২% আর আগামী বাজেটে তা ১৫.১%। সে হিসেবে চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ কমেছে।
আন্তর্জাতিক মানদন্ডে জিডিপির ৬% অথবা বাজেটের ২০% শিক্ষার জন্য বরাদ্দ থাকলে তাকে আদর্শ বাজেট ধরা হয়। ইউনেস্কোও এটি বলে আসছে এবং সাক্ষরতা অভিযান কর্তৃপক্ষ দাবিও জানিয়েছিল কিন্তু তা কাঙ্খিত লক্ষে পৌঁছেনি।
শিক্ষা খাতে সামান্য বাজেট বাড়লেও, বাজেটে বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য নেই কোন সুখবর। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের জন্য কোনো বরাদ্দ উল্লেখ করা হয়নি এ বাজেটে। অথচ, গত বাজেটে ২৭৩০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। যদিও পরে, কাটছাঁট করে ২৬১৫ টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছিল। এখনো অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওর বাহিরে রয়ে গেছে। একবুক হতাশা আর পেটে ক্ষুধা নিয়েই এসব নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণকে ক্লাসরুমে ভাল পাঠদান করতে হবে। এভাবে কতদিন চলবে তা হয়ত কারোরই জানা নেই। তবে, শিক্ষামন্ত্রী দিপুমনি বলেছেন, এমপিওভুক্তিকরণ চলমান প্রক্রিয়া। তা চলতেই থাকবে। হয়ত, এ আশায় বুক বেঁধে একটি সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় আবারও যাত্রা শুরু করবে নন-এমপিও শিক্ষকগণ। ততক্ষণে হয়তো দু/একটা ইতিহাসও হয়ে যাবে। ময়মনসিংহ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ হাফিজুর রহমান সজলের মত সহৃদয়বানগণ কারোর পাশে নীরবে দাঁড়ালেও সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে আমরা তাৎক্ষণিকভাবেই জেনে যাব একজন মানুষ গড়ার কারিগরের হালহাকিকত।
উপবৃত্তির আওতা বাড়ানোর নির্দেশনাও নেই এ বাজেটে। অথচ, বর্তমান সময়ে কর্মহীনদের সন্তানদের জন্য পড়াশোনায় যুক্ত থাকা ও মনোযোগী হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ উৎস এটি।
সবসময় আরো জানুন- বিশ্বের করোনা পরিস্থিতির রিয়েল টাইম আপডেট
বাজেটে বেসরকারি শিক্ষকদের প্রাণের দাবী-১০০% উৎসব বোনাস, বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা প্রভৃতি বৃদ্ধিকরণের ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা নেই। যথাযথ যোগ্যতা, একই সিলেবাস, একই কারিকুলাম,একই গ্রেডে চাকরি করা সত্ত্বেও বেতন, বোনাস, বাড়িভাড়া, প্রভৃতি ক্ষেত্রে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মধ্যে চরম বৈষম্য বিদ্যমান। একই দেশে দুই নীতি বিমাতাসুলভ। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারিকরণের লক্ষ্যে দীর্ঘ সময় ধরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ আন্দোলন করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সরকারের সাথে শিক্ষক নেতাগণ যোগাযোগ করেছেন, স্মারকলিপি দিয়েছেন সরকারিকরণের গুরুত্বটুকু বুঝানোর জন্য। সরকারি হলে শিক্ষকগণই শুধু উপকৃত হবেনা। পুরো জাতি উপকৃত হবে। শিক্ষা যদি জাতির মেরুদন্ডই হয় তাহলে পুরো মেরুদণ্ডটাই সমতালে মজবুত হওয়া প্রয়োজন। পুরো মেরুদন্ডের ৩% প্রচন্ড মজবুত হলেও বাকি ৯৭% দুর্বল থাকলে সুষম উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়। সেই মেরুদন্ড থুবড়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। যথাযথ শিক্ষা একটা জাতিকে, একটা দেশকে বদলে দিতে পারে।নিয়ে যেতে পারে উন্নয়ন ও উৎকর্ষতার চরম শিখরে। পিছুটানহীন একজন কারিগরই পারেন তার কাজে যথাযথ মনোযোগ দিতে। তাই জাতির স্বার্থেই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি করা এখন জাতির জাতীয় দাবি। কিন্তু, আসন্ন বাজেটে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণ বা বৈষম্য দূরীকরণ সম্পর্কে কোন নির্দেশনা নেই।
যাইহোক, শিক্ষা খাতে অন্তত একটি সুখবর আছে এ বাজেটে। আর তা হলো- সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দুপুরে রান্না করা খাবার পরিবেশন করা হবে। স্কুল ফিডিং প্রজেক্টের জন্য সাড়ে ১০ হাজার মেট্টিক টন খাদ্যশস্য মজুদ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য খুবই ইতিবাচক একটি পদক্ষেপ। দুপুরে খাওয়ার জন্য আমাদের কোমলমতি,কচিকাঁচারা আর বাড়ি যাবেনা, পাঠগ্রহণ ও বাঁধাগ্রস্ত হবেনা। এভাবেই হয়তো আমাদের প্রজ্ঞাবান প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষা বিভাগকেও যথাযথভাবে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে অচিরেই সরকারি ঘোষণা করবেন-সেই প্রত্যাশাই করি।
ম. শাহানূর আলম খাঁন
এমএ (ইংরেজি চ), এমবিএস (ব্যব.)
বিএড, এলএল বি
সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি)
বাংগরা উমালোচন উচ্চবিদ্যালয়
মুরাদনগর, কুমিল্লা।
শিক্ষার সকল খবর পেতে Shikkhapedia.com এর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করে যুক্ত থাকুন।
সবসময় রিয়েল টাইম নিউজফিড পেতে আমাদের ফেইসবুক পেইজে লাইক দিয়ে যুক্ত থাকুন