
বাঙালির মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল এখান থেকেই। প্রতিবাদের দাবানলও জ্বলে উঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মাটিতেই। বায়ান্নার ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। রক্ত দিয়েছিলেন, দিয়েছিলেন প্রাণ। ভাষাশহীদ বরকত ছিলেন এখানকার মাস্টার্সের ছাত্র।
শহীদ বরকতের প্রাণহীন লাশের পাশে বসে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি’- অমর গানটি লিখেছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই বাংলা বিভাগের তরুণ ছাত্র আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। মহান একুশে ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পরম মমতায় কোরাসে গাওয়া হয় এই গান। মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার গৌরবগাথা এ বিশ্ববিদ্যালয়কে ইতিহাসে অম্লান করেছে।গৌরবের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার শতবর্ষ পূরণ করেছে সম্প্রতি।
ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের ভিত্তিভূমি। বাঙালি জাতির ইতিহাসে অন্যতম গৌরবময় অধ্যায় ভাষা আন্দোলন। এ জাতি যে অধিকারের প্রশ্নে একচুলও ছাড় দিতে নারাজ, এই আন্দোলনের মাধ্যমে তা টের পেয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। জন্মের পর মায়ের কাছ থেকে শেখা প্রথম ভাষার প্রতি মানুষের গভীর আবেগ কাজ করে। সেই ভাষার ওপর আঘাত এলে মানুষ তা সইতে পারে না। অদম্য এই বাঙালি জাতিও তা পারেনি। ফলে এ দেশের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ভাষা আন্দোলনে। আর এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলায় সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন।
মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে একে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার গণদাবি ওঠে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও এর বীজ রোপিত হয়েছিল বহু আগে। অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।পাকিস্তানের জন্মের মাস সাতেক পরে, ১৯৪৮ সালের মার্চে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ তার জীবনে প্রথম ও শেষবারের মতো পূর্ববঙ্গে এসেছিলেন।
তিনি হয়তো ভাবেননি যে, সেখানে তার উচ্চারিত কিছু কথা একসময় তারই প্রতিষ্ঠিত নতুন দেশটির ভাঙন ডেকে আনতে ভূমিকা রাখবে। জিন্নাহ তখন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল, গণপরিষদের সভাপতি এবং মুসলিম লিগেরও সভাপতি।৯ দিনের পূর্ববঙ্গ সফরে তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রামে কয়েকটি সভায় বক্তৃতা দেন। প্রথম সভাটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে, যা এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এখানে ইংরেজিতে বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি খুব স্পষ্ট করেই আপনাদের বলছি যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং অন্য কোনো ভাষা নয়। কেউ যদি আপনাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে, তাহলে সে আসলে পাকিস্তানের শত্রু।’সফর শুরুর পাঁচ দিন পর জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ছাত্রদের সামনে আরও একটি ভাষণ দেন।
সেখানেও একই কথা বলেন তিনি। বললেন, পাকিস্তানের প্রদেশগুলো নিজেদের সরকারি কাজে যে কোনো ভাষা ব্যবহার করতে পারে। তবে রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে একটিই এবং তা হবে উর্দু। জিন্নাহর এই বক্তৃতাগুলোর কথা পরে বহু ইতিহাসবিদউল্লেখ করেছেন। তারা লিখেছেন, কার্জন হলে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলার পর কয়েকজন ছাত্র ‘না, না’ বলে চিৎকার করে প্রতিবাদ করেছিলেন, যা তাকে কিছুটা অপ্রস্তুত করেছিল। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে আবার বক্তৃতা শুরু করেছিলেন তিনি।নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা কী হবে, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল ভারত ভাগের আগেই।
অবাঙালি মুসলিম রাজনীতিবিদ ও অধ্যাপক-বুদ্ধিজীবীরা বলছিলেন উর্দু ভাষার কথা। অন্যদিকে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও এনামুল হকের মতো বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা এর প্রতিবাদ করছিলেন।বাংলার পক্ষে জনমত গড়তে ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিস গঠিত হয়। এটিই ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগঠন। সংগঠনটি প্রচার, প্রচারণাসহ বিভিন্ন উপায়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে দাবি জানিয়ে আসছিল। তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ভাষা আন্দোলনের ওপর প্রথম পুস্তিকা ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে? বাংলা নাকি উর্দু?’ প্রকাশিত হয়। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, দৈনিক ইত্তেহাদের সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ এবং তমদ্দুন মজলিসপ্রধান অধ্যাপক আবুল কাসেমের নিবন্ধ ছিল।নিবন্ধে আবুল মনসুর আহমদ লিখেছিলেন, ‘উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করিলে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ রাতারাতি অশিক্ষিত ও সরকারি চাকরির অযোগ্য বনিয়া যাইবেন।
ঠিক যা ঘটেছিল ব্রিটিশরা ফার্সির জায়গায় ইংরেজিকে ভারতের রাষ্ট্রীয় ভাষা করার পর ভারতের মুসলিম শিক্ষিত সমাজের ক্ষেত্রে।’ওই পুস্তিকায় একটি চমকপ্রদ কথা লিখেছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালি হিন্দু-মুসলামের ওপর রাষ্ট্রভাষারূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ ধূমায়িত অসন্তোষ বেশিদিন চাপা থাকতে পারে না।
শিগগির তাহলে পূর্ব-পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হওয়ার আশঙ্কা আছে।’ তার এ বক্তব্যে পাকিস্তানের ভাঙনের পূর্বাভাষ ছিল।১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দুতে কার্যক্রম পরিচালিত হলে পূর্ব বাংলা কংগ্রেস পার্টির সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এর প্রতিবাদ করেন। তিনি ‘বাংলা’ ভাষাকেও অধিবেশনের ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। এর কয়েক দিন পর ২ মার্চ দ্বিতীয়বারের মতো ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। একই বছর ‘বাংলা ভাষা আরবি হরফে’ লেখার প্রস্তাব দিলে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ? এর প্রতিবাদ করেন।১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি নতুন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে বলে ঘোষণা দেন। এর প্রতিবাদে নতুন করে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি সভা ও ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টায় ১৪৪ ধারা ভেঙে ঢাকা মেডিকেল কলেজ চত্বরে ছাত্রদের সভা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। পুলিশ ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায়। এ সময় পৃথিবীতে ভাষার জন্য প্রথম শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউলসহ অনেকে।
১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সারারাত জেগে একটি স্মৃতিস্তম্ভ বা শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। পুলিশ এ মিনারটি ভেঙে দেয়। ১৯৫৩ সালে অস্থায়ী শহীদ মিনারের স্থানে শিল্পী হামিদুর রহমানের নকশা ও পরিকল্পনায় শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। ১৯৫৬ সালে সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়।ভাষাশহীদদের স্মরণে আরেক ভাষাসংগ্রামী আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচনা করেন ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি?’ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের এক অনুষ্ঠানে সম্প্রতি তিনি বলেন, ‘১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মিছিলে গুলিবর্ষণের পরই শহীদ রফিকের লাশ দেখে আমি আমার গানটি লিখি। এটি এখন ভাষা আন্দোলনের গান।’ভাষার জন্য জীবন দেওয়ার ঘটনা পৃথিবীতে বিরল। এর ফলে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিসে ইউনেস্কোর অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে এই দিনটি সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান সমকালকে বলেন, ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ তথা ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে তথা বিশ্ব ইতিহাসের একটি গুরুত্ববহ অধ্যায়। এ আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দিয়েছেন।
এই আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ গাজীউল হক, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, রফিক প্রমুখ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই আন্দোলন থেকে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা বিকাশ লাভ করে। এই চেতনাই পরবর্তীতে এদেশের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে প্রেরণা জোগায়।বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন এবং নিজেও সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। সমকালকে তিনি বলেন, শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, বরং এদেশের সব আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ভাষা আন্দোলন তো ছিল এসব আন্দোলন-সংগ্রামের সূচনা মাত্র। এসব কারণে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ক্ষোভ ছিল। তাই ২৫ মার্চের কালরাতে প্রথমে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পর হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। ভাষা আন্দোলন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়- একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ