Home মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তিযুদ্ধের উজ্জীবনী শক্তি

মুক্তিযুদ্ধের উজ্জীবনী শক্তি

মুক্তিযুদ্ধের উজ্জীবনী শক্তি

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে উজ্জীবনী শক্তি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সরব ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বর্বর পাকিস্তান বাহিনীর হাত থেকে এ দেশের মাটিকে মুক্ত করতে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তারা। বাংলাদেশের জাতির পিতা ও প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বরেণ্য অনেক রাজনীতিবিদই ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সরব ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বর্বর পাকিস্তান বাহিনীর হাত থেকে এ দেশের মাটিকে মুক্ত করতে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তারা। বাংলাদেশের জাতির পিতা ও প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বরেণ্য অনেক রাজনীতিবিদই ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তান বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে এর প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিলেন ঢাবির তৎকালীন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।

তিনি পরবর্তী সময়ে মুজিবনগর সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠন এবং পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবাসে আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।মূলত ঢাবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সৃষ্টি করেছেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।১৯২১ সালের ১ জুলাই পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটিশ সরকার। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ব্রিটিশদের প্রায় ২০০ বছরের দুঃশাসনের অবসান ঘটে। কিন্তু সেই পাকিস্তান বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হয়। মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই পাকিস্তান বাহিনীর হাতে প্রাণ দিতে হয় শহীদ রফিক, জব্বারসহ কয়েকজন ভাষাসংগ্রামীকে। ১৯৬২ ও ১৯৬৪-তে শিক্ষা কমিশন রিপোর্টবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফার আন্দোলন, ১৯৬৮ সালের এগারো দফার আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচনসহ অন্যান্য আন্দোলন-সংগ্রামেও অনন্য ভূমিকা রাখে এ বিশ্ববিদ্যালয়।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাবির কলা অনুষদ ভবনের সামনে লাল-সবুজের বাংলাদেশের পতাকা প্রথম প্রকাশ্যে উত্তোলন করেন তৎকালীন ডাকসুর ভিপি ও ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আ স ম আব্দুর রব। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর ঢাবির ছাত্র-শিক্ষকসহ অন্যরা সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু করে। শত শত ছেলেমেয়ে প্রায় প্রতিদিনই কাঠের রাইফেল হাতে ঢাকার রাজপথে জনগণকে প্রেরণা দিতে ‘সশস্ত্র মার্চপাস্ট ও মহড়া’ দেন।২৩ মার্চ ঢাবির তরুণ-যুবকদের একাংশ ঢাকায় পল্টনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। পরে সেখান থেকে মার্চপাস্ট করে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাতে সেই পতাকা তুলে দেন তারা। এসব কারণে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্ততান সশস্ত্র বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকেই শুরু করে বাঙালি নিধনে ‘অপারেশন সার্চলাইট’।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ শিরোনামের বইয়ে ২৬ মার্চ ঢাবি এলাকা পরিদর্শনের উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘দূর থেকে মনে হয়েছিল, হামলার সময় ইকবাল হল (বর্তমানে জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হল দুটিই মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। …ক্ষতির পরিমাণ ছিল নিদারুণ। অদূরে ছিল পাঁচ থেকে পনের মিটার ব্যাসার্ধের তিনটি গণকবর। জানতে চাইলেও কোনো অফিসার হতাহতের সংখ্যা বলতে চায়নি। সেনাবাহিনীর অফিসারেরা নিজেদের মধ্যে একশর মতো হতাহতের কথা বলেছিল।’ তবে সরকারিভাবে চল্লিশজন নিহত (শহীদ) হওয়ার খবর স্বীকার করা হয়।২৫ মার্চের কালরাতে ঢাবিতে কতজন শহীদ হয়েছিলেন, তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা কখনও হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ১৯৫ জনের নাম রয়েছে।

তাদের মধ্যে শিক্ষক ১৯ জন, ছাত্র ১০১ জন, কর্মকর্তা একজন ও কর্মচারী ২৮ জন।পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরুর পর এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্ররা সশস্ত্র যুদ্ধে যোগ দেয়। এখানকার বহু ছাত্র বিদেশের বহু জায়গায় মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করার জন্য অর্থ সংগ্রহ, ওষুধ সরবরাহ, জামাকাপড় সংগ্রহ ইত্যাদি কাজে সম্পৃক্ত থেকে রাখেন অনন্য ভূমিকা।মুক্তিযুদ্ধকে সুসংগঠিতভাবে পরিচালনার জন্য বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। এ সময় বিভিন্ন ধরনের বাহিনীও গড়ে উঠেছিল। ঢাবির অনেক ছাত্রও এগুলোর নেতৃত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি দিক ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। চট্টগ্রাম থেকে সম্প্রচারিত এই বেতার কেন্দ্র ছিল মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণার শক্তি।

এর সঙ্গে ঢাবির অনেকেই যুক্ত ছিলেন, যাদের মধ্যে এম আর আখতার মুকুলের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘চরমপত্র’ ছিল অন্যতম। সে সময়কার সাড়া জাগানো সংগীত ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’ও ছিল ঢাবির ছাত্র আপেল মাহমুদের কণ্ঠে।মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ নেওয়ায় আগস্টে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবুল খায়ের, রফিকুল ইসলাম, আহসানুল হক, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সাদউদ্দিন, রাশিদুল হাসানকে ঢাকার মোহাম্মদপুরের নিপীড়ন কেন্দ্রে আটকে রেখে নির্যাতন চালানো হয়। বন্দি করা হয়েছিল কে এম সালাউদ্দিন, গিয়াসুদ্দিন আহমদ, জহুরুল হকসহ অনেককে। পূর্ব বাংলার তৎকালীন গভর্নর টিক্কা খান লিখিতভাবে সতর্ক করেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিম, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও অধ্যাপক এনামুল হককে। ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানকে ছয় মাসের আটকাদেশ দিলেও তাকে ধরতে পারেনি।

দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে তার অনুপস্থিতিতে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ভারতে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধের সহায়কশক্তি হিসেবে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্টশিয়াসহ তিনটি সংগঠন গঠনে ভূমিকা রেখেছিলেন। ঢাকায় এ বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে ছাত্র-শিক্ষকরা মুক্তিযুদ্ধের বহুবিধ কর্ম পরিচালনা করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এ জন্য তাদের বহু মূল্যও দিতে হয়েছে। ১৪ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানিদের হাতে ইতিহাস বিভাগের সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, আবুল খয়েরসহ অনেকেই শহীদ হন।

ষাটের দশকে ডাকসুর সাবেক ভিপি এবং পরে ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর তোফায়েল আহমেদ। পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা প্রসঙ্গে তিনি সমকালকে বলেন, ‘২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকার চারটি স্থানকে টার্গেট করে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধুর বাসভবন, বর্তমান বিজিবি সদর দপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স। এ চারটি স্থানে তারা গণহত্যা শুরু করে। গণহত্যার সেই বিভীষিকাময় রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ছাত্রাবাসগুলো ও মধুর ক্যান্টিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রোষানলে পড়ে। গণহত্যা শুরুর প্রথম প্রহরেই ইকবাল হলে শহীদ হন ছাত্রলীগ নেতা জাফর আহমদ ও হেলালুর রহমান চিশতী। পাকিস্তান বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন মধুদা, তার স্ত্রী, বড় ছেলে ও তার নববিবাহিত স্ত্রীসহ অনেকেই।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম বলেই এ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবন দিয়ে আরও অনেকের মতো আমিও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলাম। এটি আমার গর্ব।’ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনে তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান অনবদ্য অবদান রেখেছিলেন। এখান থেকে অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধসম্পন্ন বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা বিকাশ লাভ করেছিল। পরবর্তী সময়ে ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ এবং রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনকে বেগবান ও সমন্বিত বাঙালি জাতিসত্তার একটি আন্দোলনকে সফল করতে এই চেতনা কাজ করেছিল।

এ চেতনাই মুক্তিযুদ্ধের চালিকাশক্তি হিসেবে মৌলিক ভূমিকা রাখে, যার নেতৃত্বেও ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’সংশোধনরোববার সমকালের শেষ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ‘মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার গৌরবগাথা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ভুলবশত লেখা হয় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি’- অমর গানটি লিখেছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই বাংলা বিভাগের তরুণ ছাত্র আবদুল গাফ্‌থফার চৌধুরী। প্রকৃতপক্ষে, গানটি রচনার সময় আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here