
খায়রুন নাহার লিপি রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। ২০১৯ সালে তিনি প্রাথমিকের শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষা পদক লাভ করেন। ২০০০ সালে পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলায় চাকরিতে যোগ দিয়ে ১২ বছর পর স্বামীর কর্মস্থল ঢাকায় বদলি হয়ে আসেন। এখন প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরু হলে তিনি জানতে পারেন, জ্যেষ্ঠতা নিরূপণে তার বদলির আগের কর্মকাল ধরা হবে না। এতে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। কোন যুক্তিতে তার পেশাগত জীবনের ১২টি বছর শূন্য হয়ে যাবে?
প্রায় ২১ বছর সহকারী শিক্ষক পদে চাকরির পর প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির স্বপ্ন দেখা লিপির প্রশ্ন- ‘এক জায়গা থেকে অন্য স্থানে বদলি হলে জ্যেষ্ঠতা খুইয়ে জুনিয়র হয়ে যাওয়ার অদ্ভুত নিয়ম অন্য কোনো সরকারি চাকরিতে আছে কি? আমাদের নিয়োগ ও পদোন্নতির বিধিমালায় তো এমন কথা বলা ছিল না। থাকলে তো বদলি হয়ে আসতাম না।’
জানা গেছে, সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সহকারী শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি দিতে জ্যেষ্ঠতার তালিকা (গ্রেডেশন লিস্ট) চূড়ান্তকরণের কাজ হাতে নিয়েছে। গত মাস থেকে শিক্ষকদের অনলাইনে একটি ফরম পূরণ করতে হচ্ছে। সেখানে একটি প্রশ্ন রয়েছে- আপনি বহিরাগত শিক্ষক কিনা? কবে এ উপজেলা/থানায় যোগ দিয়েছেন?
প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়োগ করা হয় উপজেলাভিত্তিক। নিজ উপজেলার বাইরে অন্যত্র বদলি হয়ে গেলে নতুন কর্মস্থলে ওই শিক্ষককে ‘বহিরাগত শিক্ষক’ বলা হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনে। প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির প্রশ্নে ‘বহিরাগত’ ও ‘স্থানীয়’ এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছেন সারাদেশে সহকারী
শিক্ষকরা।সংকটের রূপ: খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিয়োগবিধি অনুসারে, প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরি হয় উপজেলাভিত্তিক। তবে বদলির সুযোগ রয়েছে। সেটা না থাকলে নতুন সংকট হতো না। ২০১৯ সালের নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন নীতিমালায় কোথাও বলা নেই যে বদলি হলে আগের অভিজ্ঞতা গণনা করা হবে না। অথচ এবার প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তৈরি করা গ্রেডেশন সফটওয়্যারে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণে বর্তমান উপজেলায় যোগদানের তারিখ থেকে হিসাব করা হচ্ছে। যুক্তি দেওয়া হচ্ছে যে, নিয়োগটাই উপজেলাভিত্তিক। ‘বহিরাগত’ শিক্ষকদের কারণে ‘স্থানীয়’ শিক্ষকরা সিনিয়রিটি হারাচ্ছেন।
স্থানীয়ভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত কেউ দীর্ঘদিন চাকরি করেও পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, যদি বাইরে থেকে কেউ বেশি দিনের চাকরিকাল নিয়ে আসেন। শিক্ষকদের গ্রেডেশন তালিকার নতুন সফটওয়্যারে বদলি হওয়া শিক্ষকদের ‘বহিরাগত’ হিসেবে দেখানো হচ্ছে এবং সিনিয়রিটি নির্ধারণে চাকরিতে যোগদানের তারিখের পরিবর্তে বর্তমান উপজেলায় বদলি হয়ে আসার তারিখ থেকে কার্যকাল ধরা হচ্ছে।
এই বিধানকে বদলি হওয়া শিক্ষকরা অন্যায় ও অবিচার হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, নিয়োগের সময় এই শর্ত থাকলে তারা সেভাবেই জানতেন এবং বদলি হতেন না। দেশের নাগরিকরা দেশের সব জায়গায় সমান অধিকার ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারী। তবে বিশেষ চাকরিতে বিশেষ শর্ত আরোপ করলে তা নিয়োগের আগেই জানতে হবে।
অন্যদিকে ‘স্থানীয়’ শিক্ষকরা এই গ্রেডেশন প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়ে বলছেন, ‘বহিরাগত’ শিক্ষকদের কারণে তারা সিনিয়রিটি হারাচ্ছেন এবং তাদের উপজেলার শূন্য পদ অন্যরা এসে পূরণ করলে তাদের চাকরির সুযোগও কমছে। তারা আরও জানান, সদর উপজেলা, সিটি করপোরেশন প্রভৃতি শহরাঞ্চলে বদলি হয়ে আসার প্রবণতা বেশি। ফলে এসব এলাকার স্থানীয়দের সুযোগ সংকুচিত হয় এবং বেকারত্ব বাড়ে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ময়মনসিংহ মহানগরীর একজন শিক্ষক সমকালকে বলেন, সর্বশেষ সহকারী শিক্ষক নিয়োগকালে ময়মনসিংহ সদর উপজেলা থেকে মাত্র দুইজন শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন। অথচ জেলার অন্যান্য উপজেলায় ৭০ থেকে ৮০ জন করে প্রার্থী নিয়োগ পেয়েছেন। এই শিক্ষকের বক্তব্য, মহানগরে এমন ৭০/৮০ জন নতুন শিক্ষক নিয়োগ হলে তিনিই সিনিয়র হতেন। কিন্তু বাইরে থেকে শিক্ষকরা আসায় সিনিয়রিটিতে তিনি পিছিয়ে পড়বেন এবং স্থানীয়রা চাকরিবঞ্চিত হবেন। তাই তিনি নতুন নিয়মের পক্ষে।
চাঁদপুর জেলার ৬০নং কোয়াকোর্ট মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ওমর খৈয়াম বাগদাদী রুমী সমকালকে বলেন, স্থানীয় শিক্ষকদের অগ্রাধিকার দিয়েই গ্রেডেশন তালিকা তৈরি করা হোক। এতে অপ্রয়োজনীয় বদলিগুলো ঠেকানো যাবে।শিক্ষকরা জানান, নিয়োগবিধিতে কোথাও ‘বহিরাগত শিক্ষক’ বলে কিছু না থাকায় নতুন নিয়মের আইনগত কোনো ভিত্তিই নেই।
বদলি নীতিমালায় বলা আছে, কোনো উপজেলায় সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ শিক্ষক অন্যত্র থেকে বদলি হয়ে আসতে পারবেন। পরে পৃথক আরেকটি সার্কুলার জারি করে বলা হয়, ২০ শতাংশ শিক্ষক আসতে পারবেন। তবে বাস্তবে এই হার কোথাও কোথাও ৩০ থেকে ৪০ শতাংশও ছাড়িয়ে গেছে। বিভিন্ন সুবিধার জন্য বদলির আকাঙ্ক্ষা থাকে, এর মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর দুই জায়গায় চাকরি হলে পরিবারের একত্রে থাকার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষকদের পাল্টাপাল্টি :রাজধানীর লালবাগ থানার হাজী ইব্রাহীম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘ঢাকা মহানগরীতে আমরা ৩০/৩৫ বছর চাকরি করেও পদোন্নতি পাই না। এর একটাই কারণ, বাইরে থেকে সিনিয়র শিক্ষকরা বদলি হয়ে আসেন। এখন ঢাকা মহানগরীতে প্রতিটি থানা অনুযায়ী গ্রেডেশন তালিকা হচ্ছে। এতে স্থানীয় শিক্ষকদের সুযোগ বাড়ছে। কর্তৃপক্ষের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।
‘অপরদিকে, ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার জিঞ্জিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিগার সুলতানা বলেন, ‘আমার চাকরি ১৯৯৩ সালের ৫ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখান উপজেলায়। আমি সিরাজদীখান উপজেলা থেকে ২০০০ সালে স্বামীর কর্মস্থল ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ উপজেলায় বদলি হয়ে এসেছি। মুন্সীগঞ্জ থাকলে এতো দিনে আমার পদোন্নতি হয়ে যেত।
এখন এখানেও যদি সিনিয়রিটি হারাই তাহলে আমার পদোন্নতি ২১ বছর পিছিয়ে যাবে। অথচ আমার চাকরি আছে আর মাত্র ১০ বছর। বদলি হলে প্রমোশন পিছিয়ে যাবে এমন শর্তের কথা শুনলে আমি বদলিই হতাম না। ২০০৬ সালের পদোন্নতি বিধিমালায়ও বলা হয়নি যে, বহিরাগতরা সিনিয়রিটি হারাবেন। আমি তো তার আগেই বদলি হয়ে এসেছি।’
নোয়াখালী সদর উপজেলার পূর্ব ভাটিরটেক রহমানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জহুরা ইয়াসমিন বলেন, ‘বদলি নীতিমালা মেনেই বদলি হয়ে এসেছি। সিনিয়রিটি হারানোর কোনো শর্ত সেখানে ছিল না। এর আগেও বদলি হয়ে আসা শিক্ষকরা পদোন্নতি পেয়েছেন, তখন এমন কোনো শর্ত ছিল না। এখন আমাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে কেন নতুন নিয়ম হবে? আমরাও চাই চাকরিতে যোগদানের শুরু থেকেই সিনিয়রিটি।’বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ সমকালকে বলেন, অনেক উপজেলায় বা মহানগরীতে স্থানীয় শিক্ষকরা দীর্ঘদিন চাকরি করেও পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এটা যেমন সত্য, তেমনি বহিরাগত শিক্ষকরাও কোনো শর্ত ছাড়াই বদলি হয়ে এসেছেন। কোথাও ১৫ বছর চাকরি করেই পদোন্নতি হয়, আবার কোথাও ৩০ বছরেও তা হয় না।
তিনি বলেন, ‘এটার সমাধান হওয়া প্রয়োজন। আমরা চাই, উভয়ের স্বার্থ বিবেচনা করেই গ্রেডেশন তালিকা প্রণয়ন করা হোক।’কর্তৃপক্ষের বক্তব্য :প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম রোববার সমকালকে বলেন, ‘সফটওয়্যার থেকে এরই মধ্যে বহিরাগত শব্দটি আমরা তুলে নিয়েছি। তবে এ ইস্যুতে বেশ সমস্যা রয়ে গেছে।
বিষয়টিতে যথেষ্ট ঝামেলা আছে। একটা সিদ্ধান্তে আমাদের আসতে হবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দিকনির্দেশনা নিয়ে এ বিষয়টির সুরাহা করা হবে।’বিশেষজ্ঞ মত: সমস্যাটির প্রতি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি সমকালকে বলেন, বদলি হলে জ্যেষ্ঠতা হারাতে হবে- কোন বিবেচনায় এমন বিধান করা হচ্ছে তা বোধগম্য নয়।
এতে শিক্ষকদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে এমনিতেই নানা বৈষম্য রয়েছে। নতুন করে এ বৈষম্য সৃষ্টি করা হলে তা আইন, মানবাধিকবার ও নৈতিকতার দৃষ্টিতে অনুচিত কাজ হবে। সমাধান হিসেবে তিনি বলেন, ‘অন্যান্য সরকারি চাকরির মতোই যিনি যেদিন থেকে কর্মে নিযুক্ত হবেন সেদিন থেকেই তার জ্যেষ্ঠতা নির্ধারিত হওয়া উচিত।’